রাজ্যের নাম 'লির'... সেই রাজ্যের রাজকুমারী আঙ্গারাদের বিয়ের বয়েস হয়ে এসেছে, আঙ্গারাদের মা রানী রিগাত তাই দেশজুড়ে মেয়ের পাণিপ্রার্থী'র খোঁজে লোক পাঠিয়েছেন। লালচে সোনালী চুল আর সাগরের মতো সবুজ চোখের আঙ্গারাদ এর মতো সুন্দরী রাজপরিবারেও বেশি একটা ছিলোনা, তাকে বিয়ে করতে অনেকেই তাই মুখিয়ে ছিলো। কিন্তু হলে কি হবে, প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ঐন্দ্রজালিক পরিবারের রক্ত বইছে রাজকুমারীর শরীরে, তাই জাদুকর বাদে অন্য কাউকেই বিয়ে সে করতে পারবেনা, নিয়ম নেই।
আঙ্গারাদ গিয়েছে খেপে, বলছে '' এর চেয়ে উদ্ভট কোন নিয়মের কথা কখনো শুনিনি বাপু। একে তো রাজকুমারীর জন্য নিয়মের অভাব নেই। যেখানেই যাও অভিবাদন করে বেড়াও, রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে, তবু হাসো... আবার যখন হাসিতে পেট ফাটছে, রাগী চেহারা নিয়ে তাকিয়ে থাকো, যে জিনিস দেখলেই বিরক্তিতে কান্না পাচ্ছে, ভাব দেখাও যে এর চে মজার কিছু কখনো দেখোনি। আর এখন আমার বর'ও আমার জন্য ঠিক করে দেয়া হবে?''
রাজমাতা জবাব দিলেন, ''নিয়ম মানবার জন্য, প্রশ্ন করবার জন্য নয়। তবে হ্যাঁ, তুমি চাইলে যাকে ইচ্ছে তাকেই বিয়ে করতে পারো যতোক্ষণ পর্যন্ত নিয়ম অনুযায়ী তার সব গুণাগুণ আছে''।
আঙ্গারাদ বলে উঠলো, ''আমার তো মনে হয়, বিয়ের ব্যাপারে সবচেয়ে দরকারী হলো যে আমরা একে অন্যকে ভালোবাসি''। রাজমাতা উত্তরে বললেন, ''এ তুমি চাইতেই পারো, তবে সব চাওয়া তো আর বাস্তবে সম্ভব না''।
রানী রিগাত নির্দেশ দিলেন দেশের সব দক্ষ জাদুকরেরা যেন লির রাজসভায় এসে তাদের জাদুবিদ্যা দেখিয়ে রাজকুমারীর জন্য নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে। প্রথমে এলেন জাদুকর গিল্ডাস। তার বিশাল ভূঁড়ি, ফোলা ফোলা গালদুটো যেন কেউ মাখন লাগিয়ে চকচকে করে দিয়েছে, পরণে সোনার সুতোর কারুকাজের রত্নখচিত জামা। অনুচর হিসেবে যেসব ভৃত্যেরা এসেছে সংগে, তারাও পোশাকে-আশাকে কেউ মনিবের চেয়ে কম যায়না। তাদের দেখে রাজপরিষদেদের মধ্যে প্রশংসার গুঞ্জন উঠলো। জাদুকর তার খাড়া নাকখানি উঁচু করে হাঁটছিলেন, না তাকাচ্ছিলেন ডাইনে, না বাঁয়ে। সভার মধ্যিখান দিয়ে হেঁটে সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন রাজকুমারী আর রাজমাতার সিংহাসনের সামনে। মাথার চকচকে টাকখানি একটু নুইয়ে অভিবাদন জানিয়ে বললেন, ''মাননীয়াগণ, আমাকে মাফ করবেন, জানেনই তো আমার সময় স্বল্পতার কথা। অনেক কষ্টে আমি আমার বিশেষ ব্যস্ত সকাল থেকে একটু সময় বের করে এখানে এসেছি। আমার বিশ্বাস আপনারা অহেতুক সময় ক্ষেপণ না করে, দ্রুত বিয়ের সমস্ত কথাবার্তা সেরে ফেলবেন, বিশেষ করে প্রাথমিক বিষয়গুলো: যেমন যৌতুক হিসেবে কি দিচ্ছেন আমায় কিংবা রাজকুমারী বিয়ের উপহার স্বরূপ কি কি ধন সম্পত্তি নিয়ে যাবেন সংগে করে?''
রাজমাতা উত্তর দেবার আগেই ফেটে পড়লেন রাজকুমারী আঙ্গারাদ, ''কি? তাড়াতাড়ি? টাকা- পয়সা? শর্ত? মহাশয় গিল্ডাস আপনি বোধহয় অনেক বেশি এগিয়ে যাচ্ছেন। আমাকে যদি একজন জাদুকরকেই বিয়ে করতে হয় তাহলে আমি অবশ্যই প্রথমে তার জাদু দেখবো। তারপরে সিদ্ধান্ত নেবো কি করা যায়।''
''প্রিয় রাজকুমারী, তুচ্ছ বিষয়ে সময় নষ্ট করার কোন মানে আছে কি?'' জবাব দিলেন অহংকারী গিল্ডাস। ''আমার অপ্রতিরোধ্য সুনামই আমাকে এখানে টেনে এনেছে, আমার দক্ষতা প্রশ্নাতীত, নিঃসন্দেহে আমাকেই সবাই নির্বাচন করবে।''
মিষ্টিমুখে আঙ্গারাদ জবাব দিলেন, ''হ্যাঁ, আপনার নিজের সম্পর্কে ধারণা খুব উঁচু, সন্দেহ নেই আপনার নিজেরই অর্জন সেটা। আমাদেরও একটু সুযোগ দিন আজ আপনার ক্ষমতা দেখবার।''
ফোঁসফোঁস করতে করতে, দাঁত চিড়বিড়িয়ে গিল্ডাসকে তাই শুরু করতেই হলো। অধৈর্য হয়ে তিনি তুড়ি বাজালেন, এক ভৃত্য একটা আলখাল্লা নিয়ে এসে পরিয়ে দিলো, যা তার বাকি সমস্ত পোশাকের চেয়েও অনেক বেশি জমকালো। গিল্ডাস আরেক ভৃত্যকে বললেন জাদুর চিহ্নওয়ালা সোনালী মুকুট নিয়ে আসতে, আর সবশেষে এক ভৃত্য এলো লম্বা সোনালী এক দণ্ড নিয়ে।
তৈরী হয়ে নিয়ে গিল্ডাস মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন বিড়বিড় করে, তার ভৃত্যেরা মন্তপূত পাথরে নকশা আঁকতে শুরু করলো, তিনি কিছুক্ষণ চক্রাকারে একদিকে ঘুরলেন, এরপরে আবার উল্টোদিকে। কখনো বাহু তুলে আবার কখনো আংগুল ঘুরিয়ে, সমস্ত শরীর দুলিয়ে সেই একঘেয়ে সুরের মন্ত্র চলছিলোই। সময় যেন কাটছিলোই না... একসময়ে অধৈর্য্য হয়ে রাজকুমারী আঙ্গারাদ পা ঠুকতে শুরু করলেন মাটিতে, নখে ঠকঠক করতে লাগলেন সিংহাসনের হাতলে, আর অস্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন জানালার বাইরে। এমনকি সদাহাস্যময় রাজমাতাও রাগ আর বিরক্তির আভাস লুকিয়ে রাখতে পারছিলেন না।
গিল্ডাস তার কষ্টকর জাদুর চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছিলেন, যতোক্ষণ পর্যন্ত না তার ভ্রূ ঘামে চকচক করতে লাগলো, দম ফুরিয়ে এলো। অবশেষে একটা ছোট্ট ধূসর মেঘ আকার নিচ্ছিলো বাতাসে। জাদুকর তার প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করলেন, দুহাতে তালি বাজিয়ে আর এমন ভাবভংগি করলেন... ঠিক যেন বিশাল গামলায় কোন মণ্ড পাকাচ্ছেন তিনি। ধীরে ধীরে মেঘটা বড়ো আর কালো হচ্ছিলো আর একটা সময় পুরো রাজসভা ঘিরে ফেললো কালো মেঘটা। ছায়ারা দীর্ঘ আর গাঢ় হতে লাগলো, জানালা থেকে রোদের ছায়া মুছে গেলো, মধ্যরাতের আঁধার ঘনিয়ে এলো রাজসভায়। তার ইন্দ্রজালে মুগ্ধ সভাসদ আর রাজকর্মচারীরা ফিসফিসিয়ে প্রশংসার ধ্বনি তুলছিলেন আবারও। গিল্ডাস হাতের তুড়িতে মেঘটাকে সরালেন। অন্ধকার সরে গেলো, রাজসভা আবারো আগের মতো রোদ ঝলমল।
হাতের উল্টোপিঠে ঘামে ভেজা ভ্রূ মুছে ফেললেন গিল্ডাস, মুখে তার পরিতুষ্টির হাসি, গালে রক্তাভা। রানী রিগাত মাথা নাড়িয়ে তার ক্ষমতাকে অভিবাদন করলেন। রাজকুমারী অনেক কষ্টে হাই চেপে জিজ্ঞাসা করলেন, ''মোটে এই?'' অবাক গিল্ডাস হাঁ হয়ে গিয়ে বললেন, ''মাফ করবেন?'' রাজকুমারী আবারো শুরু করলেন, '' আপনি কেবল এইটুকুই পারেন? এই ছিলো আপনার ঝুলিতে?'' গিল্ডাস বলে উঠলেন, '' কি বলছেন রাজকুমারী, এ আমার সবচেয়ে শক্তি...'' ''প্রিয় জাদুকর''- তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আঙ্গারাদার জবাব, ''আমার কোন সন্দেহ নেই যে আপনি যা করেছেন তার জন্য আপনাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আমি কেবল আশা করছি যে নিজের কোন ক্ষতি করে ফেলেননি আপনি। আপনার জাদুর বিরুদ্ধে আমি কিছু বলছিনা, কিন্তু সত্যি বলতে কি আমি বুঝতে পারছিনা, দিনকে রাত বানাবার জন্য এতো কষ্ট করার কি দরকার ছিলো?যে কেউ ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করলে রাত তার স্বাভাবিক নিয়মেই নেমে আসবে, আপনার তৈরী ইন্দ্রজালের থেকে কয়েকগুণ বেশি সুন্দর আর মখমলময় অন্ধকার নিয়ে। আর রাতের চাঁদ আর ঝিকিমিকি তারাদের কথা নাইবা বললাম।''
''তাহলে রাজকুমারী, অনুমতি দিন আরো চমকপ্রদ কোন জাদু দেখানোর। আমি তুষারঝড় নামাতে পারি, ওরা সবসময়েই লোকেদের মুগ্ধ করেছে।''
কাঁধ নাচিয়ে হতাশ সুরে রাজকুমারি বললেন, '' কি দরকার মশাই, মৌসুম এলে তুষার আর তুষারঝড় আমরা সবাই দেখি, তাও প্রতিটা তুষারকণা একে অন্যের চেয়ে আলাদা, পারবেন তার চেয়েও ভালো কিছু করতে?''
ক্রোধে আর বিরক্তিতে ফোঁসফোঁস করতে করতে গিল্ডাসকে মেনে নিতেই হলো নিজের অক্ষমতা। তবু বলে উঠলেন, '' হয়তো রাজকীয় ভোজসভা? রাজহংসীর রোস্ট? ওয়াইন? মিষ্টি?''। আর কিছু বলবার আগে আঙ্গারাদা বলে উঠলেন, ''আমরা আমাদের রাঁধুনীর উপরেই সন্তুষ্ট, ধন্যবাদ, দরকার নেই ওসবের।''
নিজের আহত অহংকার আর রাজকুমারীর অসম্মানের খোঁচায় বিড়িবিড় করতে করতে রানীর পাশে গিয়ে বসলেন গিল্ডাস পরবর্তী পাণিপ্রার্থীর ক্ষমতা দেখার জন্য। ফিসফিসিয়ে রানীর কানে কানে বললেন ''রানীমা, কারো নিন্দে করা আমার স্বভাবে নেই, কিন্তু না বলে পারছিনা যে আর কোন জাদুকরের ক্ষমতা নেই আমার সাথে প্রতিদ্ধন্ধিতা করে।''
যাই হোক, রাজমাতা দ্বিতীয় জাদুকরকে সভায় ডাকলেন।
এবার এলেন জাদুকর গ্রিমগয়্যার; রোগা, চিমসানো চেহারা, বাঁকানো ভ্রূ আর পাতলা ঠোঁটের চারপাশে পাকানো চৌকো দাঁড়ি। কেমন একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরী করতে করতে লোহাবসানো জুতোয় ঝনঝন করে শব্দ করে এগোলেন সিংহাসনের দিকে; পেছনে উড়ছিলো তার কালো আলখাল্লা। তার সাথে সব গাঢ় রং এর হুডে মাথা ঢাকা ভৃত্যের দল, সভাসদেরা অস্বস্তিতে সরে যাচ্ছিলো ওরা পাশ দিয়ে যাবার সময়।
গ্রিমগয়্যার গিয়ে থামলেন আঙ্গারাদ এর সামনে, বাহু মুড়ে, মাথা সামনে এগিয়ে বললেন, 'রাজকুমারী, আমি এসেছি আপনার পাণি প্রার্থনা করতে আর ঘোষণা দিতে যে আমি আপনাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে রাজী আছি।'' আঙ্গারাদ বলে উঠলেন, ''বটে।'' গ্রিমগয়্যার আরো বলতে লাগলেন, '' চলুন, একে অপরকে আরেকটু জানি, লির পরিবার তার জাদুকরদের ক্ষমতার জন্য বিখ্যাত আর এই পরিবারের মেয়ের বিখ্যাত তাদের স্বাধীনচেতা মনোভাবের জন্য। আপনি আমার স্ত্রী হিসেবে যা চাইবেন তাই পাবেন, এমনকি চাওয়ার বেশিই হয়তোবা। কোনরকম বিলাসিতা থেকেই আপনাকে বঞ্চিত করা হবে না। কিন্তু আমার বাড়িতে আমিই একমাত্র প্রভু।'' আঙ্গারাদ খোঁচা দিয়ে বললেন, '' হ্যাঁ, দারুণ শোনাচ্ছে বটে!'' গ্রিমগয়্যার ওদিকে ভাষণ চালিয়েই যাচ্ছেন, '' আপনাকে পরিবারের দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে মনোযোগী হতে হবে, আনন্দ-ফূর্তি বাদ দিয়ে। আমাদের ছেলেরা হবে পৃথিবীতে সবচেয়ে ক্ষমতাধর আর তারা সবার উপরে প্রভূত্ব কায়েম করবে। এই দুই পরিবারের মিলন হবে ...'' তাকে থামিয়ে দিয়ে আঙ্গারাদ বলে উঠলেন, ''মশাই আমার পরিবার বিয়ে করছেনা, করছি আমি। আর আপনি যদি এতো আগে থেকেই জানেন যে ছেলেই জন্মাবে, মেয়ে নয়- তাহলে তো আপনি ভবিষ্যতবক্তা। যাই হোক, আমার মনে হয় আপনি আপনার জাদু প্রদর্শনী শুরু করতে পারেন।''
গ্রিমগয়্যার এক পা পিছিয়ে গিয়ে হাত তুললেন. কর্কশ স্বরে শক্তিশালী মন্ত্র পড়তে শুরু করলেন। সভাসদেরা ভয়ে ঢোঁক গিলতে শুরু করলেন, কারণ ঠিক যেন হাওয়া থেকে দানবের মতো জীবেরা বেরিয়ে এসে বাতাসে পাক খাচ্ছিলো , তাদের খোলা ধারালো শ্বদন্ত আর হাঁ করা চোয়াল। কারো গায়ে আঁশ, কারোবা নিঃশ্বাসে আগুন বেরোচ্ছে, আবার কেউ তরোয়ালোর মতো ধারালো লেজ সাঁই সাঁই করে নাড়াচ্ছে বাতাসে। জাদুকরের পাশে জড়ো হয়ে ভাঁটার মতো জ্বলজ্বলে চোখে তারা চেয়ে রইলো রাজকুমারীর দিকে।
রানী রিগাতের মুখ থেকে রক্ত সরে গিয়েছে, যদিও তিনি স্থির আর সোজা হয়ে বসে নিজের আতংক লুকানোর চেষ্টা করছিলেন।
রাজকুমারী ওদিকে বিন্দুমাত্রও ভয় না পেয়ে জীবগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ''আহা! বেচারারা বোধকরি রাতের খাবার খায়নি! আপনার ওদের আরো ভালোমতোন যত্ন নেওয়া উচিত। ওদের পশম আর চুল্ও নিয়মিত আঁচড়ে দেওয়া উচিত, আমি নিশ্চিত ওদের গায়ে পোকা আছে।''
রাজকুমারীর খোঁচায় খেপে গিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন গ্রিমগয়্যার, ''এরা কোন সাধারণ জাদু নয়, আমার স্বপ্ন থেকে তৈরী সব জীব। একমাত্র আমিই পারি ওদের ডাকতে, ওদের মতো দ্বিতীয়টি আপনি কোথাও খুঁজে পাবেন না।''
রাজকুমারী বলে উঠলেন, ''খুশিই হবো বরং না পেলে। বুঝতে পারছি মশাই, আপনি এরকম স্বপ্নই দেখে থাকবেন। কিন্তু কিছু মনে করবেন না, সত্যি বলতে কি... আমাদের বনে যেসব পশু আছে আমার বরং ওদেরকেই ভালো লাগে। হরিণেরা নিঃসন্দেহে আপনার পাশে দাঁড়ানো এইসব বিকটদর্শন জীবের থেকে শতগুণে সুন্দর, ঠিক তেমনি সুন্দর খরগোশ, ব্যাজার কিংবা আর বাকি যারা আছে। আর আমি নিশ্চিত ওদের মেজাজ-মর্জিও এদের চেয়ে ভালো।''
মুখ অন্ধকার করে, রাগ চেপে, দাঁত পিষতে পিষতে গ্রিমগয়্যার মন্ত্র পড়লেন, আর দানবগুলো যেমন তাড়াতাড়ি এসেছিলো তার চে তাড়াতাড়ি মিলিয়েও গেলো। রাণী রিগাতের ইশারায় জাদুকর তার জায়গায় গিয়ে বসলেন গিল্ডাসেরই পাশে। দুই জাদুকর একে অন্যকে চোখের ছুরিতে বিঁধছিলেন যেন।
আঙ্গারাদ ফিসফিসিয়ে মায়ের কানে কানে বললেন, ''এখন পর্যন্ত, আমার পছন্দ খুবই সোজা, এদের কেউই না। আর কেউ নেই? আমি চাইছিনা এক দংগল লোক আসুক আমাকে বিয়ে করার জন্য , কিন্ত ভাবতেও ঘেন্না হচ্ছে যে মাত্র দুজনেই আগ্রহী হলো তাও আবার এই দুজন। ''
রানী রিগাত বলতে শুরু করছিলেন ,'' কি আর করবে মেয়ে, আর তো কেউ নেই''। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রধান স্টুয়ার্ড চুপি চুপি তার কানে কি যেন বললেন। রানী রাজকুমারীর দিকে চেয়ে বললেন, ''আর একজন আছে, তার নাম জেরায়ান্ট। আমি তার কথা কখনো শুনিনি, কিন্তু সে তোমার পাণিপ্রার্থী হবার অনুমতি চাইছে।'' কাঁধ ঝাঁকিয়ে আঙ্গারাদ বলে উঠলেন, '' আমি এ দুজনকে দেখেই ক্নান্ত, নতুন আরেকজন কি আর করবে ক্লান্তি বাড়ানো ছাড়া?''
কিন্তু জাদুকর জেরায়ান্ট যখন সবার মাঝখান দিয়ে এসে দাঁড়ালেন, রাজকুমারী যেন নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলেন। নতুন এই জাদুকরের সংগে কোন ভৃত্য বা কোন পাইক পেয়াদা নেই, হাতে নেই কোন জাদুর দন্ড কিংবা মাথায় নেই সোনার মুকুট। জামাকাপড়ও নেহায়েতই সাধারণ আর চাকচিক্যবিহীন। কিন্তু সেই যুবক আঙ্গারাদের দেখা সমস্ত পুরুষের চেয়ে সুন্দর। দ্রুত হওয়া হৃদস্পন্দন আর গালের রক্তাভাকে অগ্রাহ্য করে রাজকুমারী ঘাড় হেলিয়ে গলায় একটু অবজ্ঞা ঢেলে বললেন, ''তো, জাদুকর জেরায়ান্ট, কোন জাদুর বলে আপনি আমায় বিয়ে করতে চান?''
মৃদু হেসে জেরায়ান্ট বললেন, '' কেন রাজকুমারী? কেউ কি কাউকে জাদুর বলে বিয়ে করে? আমার তো মনে হয় শুধুমাত্র ভালোবেসেই বিয়ে করা উচিত''। আঙ্গারাদ বললেন ''বেশ বলেছেন, কিন্তু সেটা কেমন করে করবেন শুনি?'' জেরায়ন্ট বললেন, '' যেমন করে একজন পুরুষ একজন নারীকে ভালোবাসে তেমনি করে... আর আপনিও নিজের পছন্দ জানাতে পারেন নির্দ্ধিধায়।''
জেরায়েন্টের চোখে চোখ পড়তেই আঙ্গারাদ বুঝলেন, একমাত্র একেই বুঝি ভালোবাসা সম্ভব। কিন্তু কোন জবাব দেওয়ার আগেই জাদুকর গিল্ডাস প্রতিবাদ করতে সামনে এগিয়ে গেলেন, আর গ্রিমগয়্যারও আসন থেকে লাফিয়ে উঠে রাগত স্বরে বললেন আর কথা না বাড়িয়ে জেরায়ান্ট যেন জাদু প্রদর্শন শুরু করেন, যেমনটি তাদেরকে করতে হয়েছিলো।
অগত্যা জেরায়ান্টকে শুরু করতেই হলো। কিন্ত বাকি দুজনের মতো জেরায়ান্ট কোন জাদুর নকশাওয়ালা পাথরও বের করলেন না, কোন মন্ত্র পড়লেন না... তার বদলে খুব শান্ত-স্বাভাবিক স্বরে তিনি বলতে লাগলেন পানি আর বনের কথা, সাগর আর আকাশের কথা, নারী আর পুরুষের কথা, ছেলেবেলা আর বার্ধক্যের কথা, জীবজগতের যতো বৈচিত্র্য আর সৌন্দর্য আছে তাদের কথা আর তার কথার জাদুতে কেমন করে এই সমস্ত একে অন্যের সাথে একই সুতোয় বোনা সেইসব রহস্যের কতা যেন দর্শকদের চোখের সামনে ভেসে যাচ্ছিলো।
কথা বলতে বলতে তিনি তার হাত বাড়িয়ে দিলেন সামনে, বিস্মিত সভায় সবাই একদম চুপ করে গেলো, কারণ তার এই সাধারণ হাতের খেলায় এক দল ধবধবে সাদা হাঁস উড়ে এসে তার চারপাশে ঘুরতে লাগলো, প্রতিটা আংগুলের ছোঁয়ায় ফুল ফুটে উঠতে লাগলো। হাত তুলতেই তার মাথার উপরে তারা'রা ঝিকিমিকি করে উঠলো আর সভার মধ্যে দিয়ে যেন আলোর ঝর্ণা বয়ে গেলো। জেরায়ান্ট দু'হাত নামিয়ে নিলেন আর তার জাদুর জগতও অদৃশ্য হয়ে গেলো। তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন খেলা শেষে, কোন কথা না বলে রাজকুমারীর চোখে চোখ রেখে অপেক্ষা করতে লাগলেন। রাজকুমারী মৃদু হেসে সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, ''আমি আমার পছন্দ ঠিক করে ফেলেছি, জাদুকর জেরায়ান্ট আমাকে বিয়ে করতে চান আর আমার হূদয়ও জয় করেছেন, তাই আমি তাকেই বিয়ে করবো।'' সভা জুড়ে সবাই আনন্দধ্বনি করে উঠলো, যখন জেরায়ান্ট আর আঙ্গারাদ একে অন্যকে আলিংগন করলেন।
কিন্ত গ্রিমগয়্যার তাদের মধ্যে এসে ক্রোধে চিতকার করে রানী রিগাত আর সভাসদদের বলতে লাগলেন, '' এ কোন জাদুকর নয়, আমার জানামতে এ যা করেছে তা কোন জাদু হতে পারেনা, এ ভণ্ড, প্রতারক। একে তাড়িয়ে দিন''। গিল্ডাসও বলে উঠলেন, ''হ্যাঁ, আমিও একে কোন যথাযথ মন্ত্র বলতে শুনি নি, এ আমাদেরকে ঠকানোর চেষ্টা করেছে, এ নেহায়েতই খেলা দেখিয়েছে, জাদু নয়।'' আঙ্গারাদ প্রতিবাদ করে উঠতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু রানী চোখের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলেন। গম্ভীর মুখে জেরায়ানটের দিকে তাকিয়ে বললেন,'' শুনলেন তো সব অভিযোগ, এসব কি সত্যি?''। জেরায়েন্ট নম্র স্বরে জবাব দিলেন, '' হ্যাঁ, সব সত্যি, আমি জন্মসূত্রে জাদুকর নই, আমার কোন উত্তরাধিকারের বলে পাওয়া ক্ষমতাও নেই, যা আমি দেখিয়েছি আমার নিজেরই তৈরী। যে পাখি আপনার দেখেছেন ওরা সত্যিকারের হাঁস নয়, সাদা কাগজের টুকরো। ফুলগুলো সব শুকনো ঘাস আর মরা পাতা। তারাগুলো একমুঠো ঝলমলে পাথর। আমি কেবল আপনাদেরকে কল্পনা করতে দিয়েছি। কিন্তু এসব যদি আপনাদের কিছু মুহূর্তের জন্যেও আনন্দ দিয়ে থাকে তবে আমার আর কিছু চাইনে।''
রানী বললেন, ''কোন সাহসে আপনি জাদুকরের ছদ্মবেশে এখানে এসেছেন?'' জেরায়ান্ট জবাব দিলেন, ''রাজকুমারীর পাণি প্রার্থনা করতে প্রয়োজনে এর চে ঢের বেশি সাহস দেখাতে পারি আমি।''
রানী বললেন, ''আমার মেয়ে বৃথাই আপনাকে পছন্দ করছে।'' আঙ্গারাদ ঘোষণা দিলেন, '' অন্য যেকোন পছন্দ বরং বৃথা হবে। অন্যেরা জন্মসূত্রে জাদুকর, আর জেরায়েন্ট নিজেই সেটা শিখেছেন। উনি মিথ্যে? উনিই বরং একমাত্র সত্যি জাদুকর।'' দীর্ঘশ্বাস ফেলে রানী জবাব দিলেন, ''হয়তো তুমি ঠিকই বলেছো, আর আমিও তোমার খুশিই চাই... কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী তুমি জেরায়ান্টকে বিয়ে করতে পারবে না।'' বাধ্য হয়ে রাজকুমারীকে সভা ছেড়ে নিজের ঘরে চলে যেতে বললেন রানী আর জেরায়ান্টকে প্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হলো। কিন্তু প্রাচীন নিয়মকে অগ্রাহ্য করে জেরায়ান্টের পথ অনুসরণ করে রাজকুমারী বেরিয়ে এলেন এবং দেখলেন জেরায়ান্ট যেন তার মনের কথা টের পেয়েই প্রাসাদের বাইরে তারই অপেক্ষায় আছেন।
প্রাসাদের পেছনে বনের ভেতর দিয়ে দুজন যখন পথ চলছিলেন, হঠাত করে আকাশ মাঝরাত্তিরের মতো কালো হয়ে এলো, যদিও দিন তখনো মাঝদুপুরও ছাড়ায় নি। আলখাল্লার ভেতর থেকে সোনালী এক গোলক বের করলেন রাজকুমারী, আর তার হাতের ছোঁয়ায় গোলক থেকে আলো বেরিয়ে এসে গিল্ডাসের বিচ্ছিরি জাদু আড়াল করে দিলো। এরপরে আঙ্গারাদ আর জেরায়ান্ট এর সামনে গ্রিমগয়্যারের ডাকে দৈত্যাকৃতির সব প্রাণীরা হাজির হলো, কিন্তু ওরা দুজন হাতে তুড়ি দিয়ে সামনে এগোতে লাগলেন। দৈত্যগুলো সব পেছনে সরে গিয়ে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালো প্রেমিক যুগলকে। বনের শেষ প্রান্তে ভীষন তুষারপাত হতে লাগলো, কনকনে শীতল বরফ ছড়িয়ে পড়তে লাগলো চারদিকে, কিন্তু একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসার উষ্ণতায় তারা সেই তুষারঝড়ও নিরাপদে পার হয়ে গেলেন। তুষারের উপর তাদের পা যেখানেই পড়ছিলো, ফুটে উঠছিলো হাজারো ফুল। এরপরের কাহিনী আপনারাই ভেবে নিন, কেমন থাকবেন এই প্রেমিক-প্রেমিকা...